স্টোয়সিজম : জীবনকে অর্থবহ করে তোলার প্রাচীন দর্শন কি আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক?

প্রাচীন গ্রীসের এক শান্ত কোণে, একদল দার্শনিক জীবনের গভীর রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, সুখ বাইরের ঘটনা বা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে আমাদের ভেতরের মানসিক শান্তির উপর। এই দার্শনিক গোষ্ঠীই স্টোয়িক (Stoic) নামে পরিচিত, এবং তাদের দর্শনের নাম স্টোয়সিজম। আজ, হাজার বছর পরেও, স্টোয়সিজমের শিক্ষা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে সাহায্য করে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই প্রাচীন দর্শন কি সত্যিই আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক?

Fumy
By Fumy
4 Min Read

স্টোয়সিজমের উৎপত্তি ও ইতিহাস:

স্টোয়সিজমের যাত্রা শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। জেনো অফ সিটিয়াম (Zeno of Citium) নামে এক দার্শনিক এথেন্সের এক বাজারে হাঁটতে হাঁটতে এই দর্শনের বীজ বপন করেন। পরবর্তীকালে এপিক্টেটাস (Epictetus), সেনেকা (Seneca), এবং মার্কাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius) এর মতো দার্শনিকরা এই দর্শনকে আরও সমৃদ্ধ করেন। মার্কাস অরেলিয়াসের “মেডিটেশনস” (Meditations) আজও স্টোয়িক দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

There are more things, Lucilius, that frighten us than injure us, and we suffer more in imagination than in reality.

– Seneca

স্টোয়সিজমের মূল নীতি:

স্টোয়সিজমের মূল লক্ষ্য হল, বাইরের ঘটনা বা পরিস্থিতির উপর নির্ভর না করে, নিজের ভেতরের শান্তি বজায় রাখা। এই দর্শন তিনটি প্রধান নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি:

১. ন্যায়পরায়ণতা (Virtue): স্টোয়িকরা বিশ্বাস করতেন, ন্যায়পরায়ণতা হল জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সততা, সাহস, ন্যায়বিচার এবং প্রজ্ঞা হল ন্যায়পরায়ণতার চারটি স্তম্ভ।

- Advertisement -

২. প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য (Living in Accordance with Nature): স্টোয়িকরা মনে করতেন, প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলা উচিত। যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা নিয়ে চিন্তা না করে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তার উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।

৩. নিয়ন্ত্রণ (Control): স্টোয়িকরা বিশ্বাস করতেন, আমাদের আবেগ এবং প্রতিক্রিয়া আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু বাইরের ঘটনা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তার উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।

স্টোয়সিজমের ব্যবহারিক প্রয়োগ:

- Advertisement -

আজকের অস্থির বিশ্বে, স্টোয়সিজমের শিক্ষা আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। স্টোয়িক দর্শনকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার কিছু উপায় নিচে আলোচনা করা হলো:

  • নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ: স্টোয়িকরা বিশ্বাস করতেন, আমাদের চিন্তাভাবনা আমাদের আবেগ তৈরি করে। তাই, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তা মেনে নেওয়া: জীবনের কিছু ঘটনা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। এই ঘটনাগুলো নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে, তা মেনে নেওয়া উচিত।
  • বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ: স্টোয়িকরা মনে করতেন, অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করে, বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
  • কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: জীবনের ছোট ছোট আনন্দের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
  • বিপদ বা কষ্টের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি: স্টোয়িকরা বিশ্বাস করতেন, জীবনের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা উচিত।

 

স্টোয়সিজমের সুবিধা:

- Advertisement -

স্টোয়সিজম মেনে চলার মাধ্যমে আমরা নিম্নলিখিত সুবিধাগুলো পেতে পারি:

  • মানসিক শান্তি: স্টোয়িক দর্শন আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • মানসিক স্থিতিশীলতা: জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে সাহায্য করে।
  • মানসিক দৃঢ়তা: কঠিন পরিস্থিতিতেও ভেঙে না পড়ে, দৃঢ় থাকতে সাহায্য করে।
  • ভালো সম্পর্ক: অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে।
  • অর্থবহ জীবন: জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

 


স্টোয়সিজমের সমালোচনা:

স্টোয়সিজমের কিছু সমালোচনাও রয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন, স্টোয়িক দর্শন আবেগ দমন করতে শেখায়, যা মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতিকে বাধা দেয়। আবার, কিছু সমালোচক মনে করেন, স্টোয়িক দর্শন সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি উদাসীন।

স্টোয়সিজম কি আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক?

আজকের অস্থির ও দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে, স্টোয়সিজমের শিক্ষা আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং অনিশ্চয়তার এই যুগে, স্টোয়িক দর্শন আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে এবং জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারে।

স্টোয়সিজম এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞান:

আধুনিক মনোবিজ্ঞানের অনেক কৌশল স্টোয়িক দর্শনের সাথে মিলে যায়। যেমন, কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) স্টোয়িক দর্শনের মতো নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়।

উপসংহার:

স্টোয়সিজম একটি প্রাচীন দর্শন হলেও, এর শিক্ষা আজও আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। এটি আমাদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে, কঠিন পরিস্থিতিতে দৃঢ় থাকতে এবং জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। তাই, স্টোয়িক দর্শন আজকের যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কিওয়ার্ড: স্টোয়সিজম, স্টোয়িক দর্শন, মার্কাস অরেলিয়াস, এপিক্টেটাস, সেনেকা, মানসিক শান্তি, জীবন দর্শন, প্রাচীন দর্শন, স্টোয়িক নীতি, স্টোয়িক জীবনযাপন, প্রাচীন গ্রীক দর্শন, জীবনকে অর্থবহ করা।

TAGGED:
Share This Article
Leave a Comment